Vidyasagar autobiography in bengali

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

জন্মঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
(১৮২০-০৯-২৬)২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০
বীরসিংহ গ্রাম, হুগলি জেলা, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত
(অধুনা ভারতেরপশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়)
মৃত্যু২৯ জুলাই ১৮৯১(1891-07-29) (বয়স ৭০)
কলকাতা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত
(অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে)
ছদ্মনামকস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য, কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য[১]
পেশালেখক,দার্শনিক, পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, প্রকাশক, সংস্কারক, মানবহিতৈষী, অধ্যক্ষ
ভাষাবাংলা ও সংস্কৃত
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারতীয়
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসংস্কৃত কলেজ (১৮২৮-১৮৩৯)
সাহিত্য আন্দোলনবাংলার নবজাগরণ
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিবর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়, আখ্যানমঞ্জরীব্যাকরণ কৌমুদী, বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (২ খণ্ডে), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (২ খণ্ডে)[১], অতি অল্প হইল(১৮৭৩), আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩), ব্রজবিলাস(১৮৮৪)
দাম্পত্যসঙ্গীদীনময়ী দেবী
সন্তাননারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
আত্মীয়ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (বাবা)
ভগবতী দেবী (মা)
শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন (সেজ ভ্রাতা)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ – ২৯ জুলাই ১৮৯১; ১২ আশ্বিন ১২২৭ – ১৩ শ্রাবণ ১২৯৭ বঙ্গাব্দ) ঊনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার ছিলেন।[২]সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল তার। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও সহজপাঠ্য করে তোলেন।[৩] বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার তিনিই। তাকে বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী বলে অভিহিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি রচনা করেছেন যুগান্তকারী শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয়-সহ একাধিক পাঠ্যপুস্তক, সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থ। সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু রচনা। নারীমুক্তির আন্দোলনেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য।

অন্যদিকে বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারকও। বিধবা বিবাহ ও স্ত্রী শিক্ষার প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে তার অক্লান্ত সংগ্রাম আজও স্মরিত হয় যথোচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে। বাংলার নবজাগরণের এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দয়ার সাগর’ নামে।[৪][৫] দরিদ্র, আর্ত ও পীড়িত কখনোই তার দ্বার থেকে শূন্য হাতে ফিরে যেত না। এমনকি নিজের চরম অর্থসঙ্কটের সময়ও তিনি ঋণ দিয়ে পরোপকার করেছেন‌। তার পিতামাতার প্রতি তার ঐকান্তিক ভক্তি ও বজ্রকঠিন চরিত্রবল বাংলায় প্রবাদপ্রতিম। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজের কর্মোদ্যম ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি।[৬]

বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর মহাশয় আজও এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পশ্চিমবঙ্গেরপশ্চিম মেদিনীপুরে তার স্মৃতিরক্ষায় স্থাপিত হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী কলকাতার আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিদ্যাসাগর সেতু তারই নামে উৎসর্গিত। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বিবিসি বাংলা কর্তৃক পরিচালিত জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ জন বাঙালির মধ্যে অষ্টম স্থান লাভ করেন।[২]

জীবনী

[সম্পাদনা]

বংশ পরিচয়

[সম্পাদনা]

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পূর্বপুরুষগণ অধুনা পশ্চিমবঙ্গেরহুগলি জেলার অন্তর্গত বনমালীপুর নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন।[৭][৮][৯]

এই বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার স্বরচিত জীবনচরিতে লিখেছেন-

বীরসিংহগ্রামে আমার জন্ম হইয়াছে; কিন্তু, এই গ্রাম আমার পিতৃপক্ষীয় অথবা মাতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বাসস্থান নহে। জাহানাবাদের (অধুনা আরামবাগ) ঈশান কোণে, তথা হইতে প্রায় তিন ক্রোশ উত্তরে, বনমালীপুর নামে যে গ্রাম আছে, উহাই আমার পিতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বহুকালের বাসস্থান। ...[১০]

ঈশ্বরচন্দ্রের প্রপিতামহদেব ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কার ছিলেন হুগলী জেলার বনমালীপুর গ্রামের বিখ্যাত পণ্ডিত। তার তৃতীয় পুত্র তথা বিদ্যাসাগরের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ বীরসিংহ গ্রামের বিদগ্ধ পণ্ডিত উমাপতি তর্কসিদ্ধান্তের তৃতীয়া কন্যা দুর্গাদেবীর পাণিগ্রহণ করেন। তাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা৷[১১] রামজয় দেশত্যাগী হলে ভাগ্যের ফেরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঠাকুমা শ্রীমতী দুর্গাদেবী তার পিতৃভূমি বীরসিংহে এসে বসবাস শুরু করেন৷ সেই থেকে তারা বীরসিংহগ্রাম নিবাসী৷[১২]

জীবনারম্ভ

[সম্পাদনা]

১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর (১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন, মঙ্গলবার) ব্রিটিশ ভারতেরবাংলা প্রেসিডেন্সির বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শর্মা জন্মগ্রহণ করেন।[১৩] এই গ্রামটি অধুনা ভারতেরপশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত হলেও, সেই যুগে ছিল হুগলি জেলার অন্তর্ভুক্ত।[১৪] ঈশ্বরচন্দ্রের পিতার নাম ছিল ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ছিল ভগবতী দেবী। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা হুগলি জেলার বনমালীপুর গ্রাম।[৭] ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত ব্যক্তি। তিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন। সেই কারণে ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব বীরসিংহেই তার মা ও ঠাকুরমার সঙ্গে অতিবাহিত হয়। [২]

শিক্ষাজীবন

[সম্পাদনা]

চার বছর নয় মাস বয়সে ঠাকুরদাস বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। কিন্তু সনাতন বিশ্বাস বিদ্যাদানের চেয়ে শাস্তিদানেই অধিক আনন্দ পেতেন। সেই কারণে রামজয় তর্কভূষণের উদ্যোগে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামে এক উৎসাহী যুবক বীরসিংহ গ্রামে একটি নতুন পাঠশালা স্থাপন করেন। আট বছর বয়সে এই পাঠশালায় ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। তার চোখে কালীকান্ত ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। কালীকান্তের পাঠশালায় তিনি সেকালের প্রচলিত বাংলা শিক্ষা লাভ করেছিলেন।

১৮২৮ সালের নভেম্বর মাসে পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। তাদের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন কালীকান্ত ও চাকর আনন্দরাম গুটিও। কথিত আছে, পদব্রজে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে তিনি সেগুলি অল্প আয়াসেই আয়ত্ত করেছিলেন। কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের বিখ্যাত সিংহ পরিবারে তারা আশ্রয় নেন। এই পরিবারের কর্তা তখন জগদ্দুর্লভ সিংহ। ১৮২৯ সালের ১ জুন সোমবার কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ( যা বর্তমানে  সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত) ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮২৪ সালে; অর্থাৎ, ঈশ্বরচন্দ্রের এই কলেজে ভর্তি হওয়ার মাত্র পাঁচ বছর আগে। তার বয়স তখন নয় বছর। এই কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। বিদ্যাসাগরের আত্মকথা থেকে জানা যায়, মোট সাড়ে তিন বছর তিনি ওই শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন।

ব্যাকরণ পড়ার সময় ১৮৩০ সালে সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণিতেও ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৩১ সালের মার্চ মাসে বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি এবং ‘আউট স্টুডেন্ট’ হিসেবে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা পারিতোষিক পান। সংস্কৃত কলেজে মাসিক বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের ‘পে স্টুডেন্ট’ ও অন্য ছাত্রদের ‘আউট স্টুডেন্ট’ বলা হত। অন্যদিকে তিন বছর ব্যাকরণ শ্রেণিতে পঠনপাঠনের পর বারো বছর বয়সে প্রবেশ করেন কাব্য শ্রেণিতে। সে যুগে এই শ্রেণির শিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। ১৮৩৩ সালে ‘পে স্টুডেন্ট’ হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র ২ টাকা পেয়েছিলেন। ১৮৩৪ সালে ইংরেজি ষষ্ঠশ্রেণির ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য ৫ টাকা মূল্যের পুস্তক পারিতোষিক হিসেবে পান। এই বছরই ক্ষীরপাই নিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দীনময়ী দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়।

১৮৩৫ সালে ইংরেজি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রূপে পলিটিক্যাল রিডার নং ৩ইংলিশ রিডার নং ২ পারিতোষিক পান। এই বছরই নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজ থেকে ইংরেজি শ্রেণি উঠিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বর্ষে সাহিত্য পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে পনেরো বছর বয়সে প্রবেশ করেন অলংকার শ্রেণিতে। অলংকার শাস্ত্র একটি অত্যন্ত কঠিন বিষয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তিনি সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশরসগঙ্গাধর প্রভৃতি অলংকার গ্রন্থে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

১৮৩৬ সালে অলংকার পাঠ শেষ করেন। বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে রঘুবংশম্, সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রত্নাবলী, মালতী মাধব, উত্তর রামচরিত, মুদ্রারাক্ষস, বিক্রমোর্বশীমৃচ্ছকটিক গ্রন্থ পারিতোষিক পান। ১৮৩৭ সালের মে মাসে তার ও মদনমোহনের মাসিক বৃত্তি বেড়ে হয় আট টাকা।

এই বছরই ঈশ্বরচন্দ্র স্মৃতি শ্রেণিতে ভর্তি হন (এই অংশের সমতুল্য আজকের সংস্কৃত কলেজ-র পঠন)। সেই যুগে স্মৃতি পড়তে হলে আগে বেদান্ত ও ন্যায়দর্শন পড়তে হত। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের মেধায় সন্তুষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে সরাসরি স্মৃতি শ্রেণিতে ভর্তি নেন। এই পরীক্ষাতেও তিনি অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন এবং হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ত্রিপুরায় জেলা জজ পণ্ডিতের পদ পেয়েও পিতার অনুরোধে তা প্রত্যাখ্যান করে ভর্তি হন বেদান্ত শ্রেণিতে। শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতি সেই সময় বেদান্তের অধ্যাপক। ১৮৩৮ সালে সমাপ্ত করেন বেদান্ত পাঠ। এই পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং মনুসংহিতা, প্রবোধ চন্দ্রোদয়, অষ্টবিংশতত্ত্ব, দত্তক চন্দ্রিকাদত্তক মীমাংসা গ্রন্থ পারিতোষিক পান। সংস্কৃতে শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা পুরস্কারও পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৪০-৪১ সালে ন্যায় শ্রেণিতে পঠনপাঠন করেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই শ্রেণিতে দ্বিতীয় বার্ষিক পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে তিনি পারিতোষিক পান। ন্যায় পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ১০০ টাকা, পদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা, দেবনাগরী হস্তাক্ষরের জন্য ৮ টাকা ও বাংলায় কোম্পানির রেগুলেশন বিষয়ক পরীক্ষায় ২৫ টাকা-সর্বসাকুল্যে ২৩৩ টাকা পারিতোষিক পেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর 'ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা' নামে স্বাক্ষর করতেন৷

বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ

[সম্পাদনা]

জন্মগ্রহণ কালে তার পিতামহ তার বংশানু্যায়ী নাম রেখেছিলেন "ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়"। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তার নামের সঙ্গে 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। এই প্রশংসাপত্রটি ছিল নিম্নরূপ :

HINDOO LAW COMMITTEE Scholarship EXAMINATION

We hereby certify that at be over Examination held at the Presidency go Fort William on the 22nd 22nd April 1839 by the Committee cut out for under the provisions of Regulation XI 1826 Issur Chandra Vidyasagar was override and declared to be qualified disrespect his eminent knowledge of the Hindoo Law to hold the office locate Hindoo Law officer in any late the Established Courts of Judicature.
H.T. Prinsep
President
J.W.J. Ousely
Member of the Chamber of Examination

This Certificate has archaic granted to the said Issur Chandra Vidyasagar under the seal of leadership committee. This 16th Sixteenth day do admin May in the year 1839 Analogous with the 3rd Third Joistha 1761 Shukavda.
J.C.C. Sutherland
Secy To character Committee (পুরনো বানান অপরিবর্তিত)

সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পর তিনি এই কলেজ থেকে অপর একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাপ্ত দেবনাগরী হরফে লিখিত এই সংস্কৃত প্রশংসাপত্রে কলেজের অধ্যাপকগণ ঈশ্বরচন্দ্রকে 'বিদ্যাসাগর' নামে অভিহিত করেন। প্রশংসাপত্রটি নিম্নরূপ:

অস্মাভিঃ শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরায় প্রশংসাপত্রং দীয়তে। অসৌ কলকাতায়াং শ্রীযুত কোম্পানী সংস্থাপিত বিদ্যামন্দিরে ১২ দ্বাদশ বৎসরান্ ৫ পঞ্চমাসাংশ্চোপস্থায়াধোলিখিত শাস্ত্রাণ্য ধীতবান্

ব্যাকরণম্... শ্রীগঙ্গাধর শর্ম্মভিঃ

কাম্যশাস্ত্রম্... শ্রীজয়গোপাল শর্ম্মভিঃ
অলঙ্কারশাস্ত্রম্... শ্রীপ্রেমচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
বেদান্তশাস্ত্রম্... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
ন্যায়শাস্ত্রম্... শ্রীজয়নারায়ণ শর্ম্মভিঃ
জ্যোতিঃশাস্ত্রম্... শ্রীযোগধ্যান শর্ম্মভিঃ
ধর্মশাস্ত্রম্... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
সুশীলতয়োপস্থিতস্বৈত স্বৈতেষু শাস্ত্রেষু সমীচীনা ব্যুৎপত্তিরজনিষ্ট।
১৭৬৩ এতচ্ছকাব্দীয় সৌরমার্গশীর্ষস্য বিংশতি দিবসীয়ম্।
রসময় দত্ত, সচিব।
১০ ডিসেম্বর ১৮৪১।

কর্মজীবন

[সম্পাদনা]

১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত হবার পর সেই বছরই ২৯ ডিসেম্বর মাত্র একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার বা প্রধান পণ্ডিতের পদে আবৃত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। বেতন ছিল মাসে ৫০ টাকা। ১৮৪৬ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি এই পদের দায়িত্বে ছিলেন। ১৮৪৬ সালের ৬ এপ্রিল একই বেতন হারে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের ভার গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স পঁচিশ বছর। ১৮৪৭ সালে স্থাপন করেন সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি নামে একটি বইয়ের দোকান। এই বছরই এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় হিন্দি বেতাল পচ্চিসী অবলম্বনে রচিত তার প্রথম গ্রন্থ বেতাল পঞ্চবিংশতি। প্রথম বিরাম চিহ্নের সফল ব্যবহার করা হয় এ গ্রন্থে। বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সম অংশীদারত্বে সংস্কৃত যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানাও স্থাপন করেন তিনি। অন্নদামঙ্গল কাব্যের পান্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য এই বছরই নদিয়ার কৃষ্ণনগরে আসেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে সংরক্ষিত মূল গ্রন্থের পাঠ অনুসারে পরিশোধিত আকারে দুই খণ্ডে অন্নদামঙ্গল সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। এই বইটিই সংস্কৃত যন্ত্র প্রেসের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। ১৮৪৭ সালের ১৬ জুলাই কলেজ পরিচালনার ব্যাপারে সেক্রেটারি রসময় দত্ত এর সঙ্গে মতান্তর দেখা দেওয়ায় সংস্কৃত কলেজের সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

১৮৪৯ সালে মার্শম্যানের হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচনা করেন বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থখানি। এই বছরেই ১ মার্চ পাঁচ হাজার টাকা জামিনে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে আবৃত হন। বন্ধু ও হিতৈষীদের সহযোগিতায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থাপনা করেন সর্ব্বশুভকরী সভা। সেপ্টেম্বরে উইলিয়াম ও রবার্ট চেম্বার্স রচিত খ্যাতিমান ইংরেজ মনীষীদের জীবনী অবলম্বনে তার লেখা জীবনচরিত গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়। ১৮৫০ সালের আগস্ট মাসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর প্রথম সংখ্যায় বাল্যবিবাহের দোষ নামে একটি বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ৪ ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াের কাজে ইস্তফা দিয়ে ৫ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন। ১৮৫১ সালের ৫ জানুয়ারি সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ ছাড়াও কলেজের অস্থায়ী সেক্রেটারির কার্যভারও গ্রহণ করেন। ২২ জানুয়ারি ১৫০ টাকা বেতনে কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এই সময় থেকেই সংস্কৃত কলেজে সেক্রেটারির পদটি বিলুপ্ত হয়। এপ্রিল মাসে রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে তার রচিত বোধোদয় পুস্তকটি প্রকাশিত হয়। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার নিয়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেন। ৯ জুলাই পূর্বতন রীতি বদলে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও কায়স্থদের সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেন। ২৬ জুলাই প্রবর্তিত হয় রবিবারের সাপ্তাহিক ছুটির প্রথা। এর আগে প্রতি অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথিতে ছুটি থাকত। ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজের দ্বার সকল বর্ণের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। নিয়ম হয়, যে কোনও সম্ভ্রান্ত হিন্দু সন্তান সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ পাবে। ১৮৫২ সালের এপ্রিলে ২৬ অনুচ্ছেদ সংবলিত নোটস অন দ্য সংস্কৃত কলেজ প্রস্তুত হয়। ২৮ আগস্ট থেকে কলেজে প্রবেশার্থী ছাত্রদের ২ টাকা দক্ষিণা দেওয়ার প্রথা চালু হয়।

১৮৫৩ সালে জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে স্থাপন করেন অবৈতনিক বিদ্যালয়। জুন মাসে কালিদাসেররঘুবংশম্ ও ভারবিরকিরাতার্জ্জুনীয়ম্ প্রকাশিত হয় তার সম্পাদনায়। সেপ্টেম্বর মাসে বারাণসীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ জেমস আর ব্যালানটাইন সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শন করে যে রিপোর্ট দেন, তার মতামত সমালোচনা করে শিক্ষা সংসদে একটি রিপোর্ট দেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। বাংলার শিক্ষার ইতিহাসে এই রিপোর্ট এক যুগান্তকারী দলিল। এই বছরেই তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ব্যাকরণ কৌমুদী প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভেঙে বোর্ড অফ একজামিনার্স গঠিত হলে তার সদস্য মনোনীত হন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ছাত্রদের থেকে মাসিক ১ টাকা বেতন নেওয়ার প্রথা চালু হয়। এই বছরেই ব্যাকরণ কৌমুদী তৃতীয় ভাগ ও কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে তার রচিত শকুন্তলা প্রকাশিত হয়। এছাড়া তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা শীর্ষক একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়।

১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব – প্রথম পুস্তক প্রকাশিত। এই বছরের এপ্রিল মাসে বাংলা নববর্ষের দিন (১লা বৈশাখ,সংবৎ ১৯১২ অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল ১৮৫৫) যুগান্তকারী বাংলা শিশুপাঠ্য বর্ণমালা শিক্ষাগ্রন্থ বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয়। কথিত আছে, মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পাল্কিতে বসে তিনি বর্ণপরিচয়-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। ১ মে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ছাড়াও মাসিক অতিরিক্ত ২০০ টাকা বেতনে দক্ষিণবঙ্গে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে নিযুক্ত হন। জুন মাসে (১৪ জুন অর্থাৎ ১লা আষাঢ় সংবৎ ১৯১২) বর্ণপরিচয় গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। ১৭ জুলাই বাংলা শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সংস্কৃত কলেজের অধীনে ওই কলেজের প্রাতঃকালীন বিভাগে নর্ম্যাল স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন তার বন্ধু এবং বিশিষ্ট বাঙালি যুক্তিবাদী ও গ্রন্থকার অক্ষয়কুমার দত্ত। এই বছরেই দক্ষিণবঙ্গের চার জেলায় একাধিক মডেল স্কুল বা বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নদিয়ায় পাঁচটি, আগস্ট-অক্টোবরে বর্ধমানে পাঁচটি, আগস্ট-সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে হুগলিতে পাঁচটি এবং অক্টোবর-ডিসেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় চারটি বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। অক্টোবর মাসে বিধবা বিবাহ বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করার পর্যাপ্ত শাস্ত্রীয় প্রমাণ সহ বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব – দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশ করেন। বিধবা বিবাহ আইনসম্মত করতে ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ সরকারের নিকট বহুসাক্ষর সংবলিত এক আবেদনপত্রও পাঠান। ২৭ ডিসেম্বর আরেকটি আবেদনপত্র পাঠান বহু বিবাহ নিবারণ বিধির জন্য।

১৮৫৬ সালের ১৪ জানুয়ারি মেদিনীপুরে পঞ্চম বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে ঈশপের কাহিনি অবলম্বনে রচিত কথামালা প্রকাশিত হয়। ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইনসম্মত হয়। এই দিনই প্রকাশিত হয় তার স্বরচিত গ্রন্থ চরিতাবলী। এই বছর ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রথম বিধবা বিবাহ আয়োজিত হয় ১২, সুকিয়া স্ট্রিটে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পাত্র ছিলেন প্রসিদ্ধ কথক রামধন তর্কবাগীশের কণিষ্ঠ পুত্র তথা সংস্কৃত কলেজের কৃতি ছাত্র ও অধ্যাপক, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পাত্রী ছিলেন বর্ধমান জেলার পলাশডাঙা গ্রামের অধিবাসী ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দ্বাদশ বর্ষীয়া বিধবা কন্যা কালীমতী।

১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি স্থাপিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির অন্যতম সদস্য তথা ফেলো মনোনীত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। উল্লেখ্য এই সমিতির ৩৯ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ছয় জন ছিলেন ভারতীয়। এই বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে হুগলি জেলায় সাতটি ও বর্ধমান জেলায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরের বছর জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে হুগলিতে আরও তেরোটি, বর্ধমানে দশটি, মেদিনীপুরে তিনটি ও নদিয়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। মোট ১৩০০ ছাত্রীসংবলিত এই বিদ্যালয়গুলির জন্য তার খরচ হত মাসে ৮৪৫ টাকা। এই ১৮৫৮ সালের ৩ নভেম্বর শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তার সঙ্গে মতবিরোধ হলে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করেন। প্রায় ৩৯ বছর বয়সে সরকারের সঙ্গে তার সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়। যদিও নিজের কাজের জন্য সরকারের তরফ থেকে কোনও রূপ স্বীকৃতি বা পেনসন তিনি পান নি।

শিক্ষাবিস্তার

[সম্পাদনা]

১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনার নেপথ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যথেষ্ট অবদান ছিল। দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম পত্রিকা যাতে রাজনৈতিক বিষয় স্থান পেয়েছিল। ১৮৫৯ সালের ১ এপ্রিল পাইকপাড়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় লা স্কুল। কিছুকাল এই প্রতিষ্ঠানের অবৈতনিক তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন তিনি। ২০ এপ্রিল মেট্রোপলিটান থিয়েটারে উমেশচন্দ্র মিত্র রচিত নাটক বিধবা বিবাহ প্রথম অভিনীত হয়। ২৩ এপ্রিল রামগোপাল মল্লিকের সিঁদুরিয়াপট্টির বাসভবনে সেই নাটকের অভিনয় দেখেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। মে মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে মিশে গেলে উক্ত সভার সভাপতির পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর গণশিক্ষার প্রসারে সরকারি অনুদানের জন্য বাংলার গভর্নরের নিকট আবেদন করেন। ১৮৬০ সালে বোর্ড অফ একজামিনার্সের পদ থেকেও ইস্তফা দেন তিনি। এই বছরই ১২ এপ্রিল ভবভূতিরউত্তর রামচরিত অবলম্বনে তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ সীতার বনবাস প্রকাশিত হয়। কথিত আছে বইখানি তিনি রচনা করেছিলেন মাত্র চারদিনে।

১৮৬১ সালের এপ্রিল মাসে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের সেক্রেটারি মনোনীত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই বছর ডিসেম্বর মাসে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণে গ্রহণ করেন তার সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার পরিচালনভার। ১৮৬২ সালে কৃষ্ণদাস পালকে এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেন তিনি। এই বছর তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাণভট্টেরকাদম্বরী। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাকে উৎসর্গ করেন স্বরচিত বীরাঙ্গনা কাব্য। ১৮৬৩ সালে সরকার তাকে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। উল্লেখ্য, ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী নাবালক জমিদারদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৮৫৬ সালে এই ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক গদ্যরচনা 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' এ বছর রচিত হয়। ১৮৬৪ সালে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের নাম পরিবর্তন করে কলিকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন রাখা হয়। ৪ জুলাই ইংল্যান্ডেররয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে সাম্মানিক সদস্য নির্বাচিত করে। খুব কম ভারতীয়ই এই বিরল সম্মানের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। ২ আগস্ট ফ্রান্সে ঋণগ্রস্ত মাইকেল মধুসূদনের সাহায্যার্থে ১৫০০ টাকা প্রেরণ করেন তিনি। ১৮৬৫ সালের ১১ জানুয়ারি ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যাসাগর মহাশয় তার প্রথম রিপোর্টটি পেশ করেন।

১৮৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বহুবিবাহ রদের জন্য দ্বিতীয়বার ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার নিকট আবেদনপত্র পাঠান বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই বছরই প্রকাশিত হয় তার পরিমার্জিত আখ্যান মঞ্জরী পুস্তকের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। ১৮৬৭ সালের জুলাই মাসে জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতার সঙ্গে গোপালচন্দ্র সমাজপতির বিবাহ হয়। এবছর অনাসৃষ্টির কারণে বাংলায় তীব্র অন্নসংকট দেখা দিলে তিনি বীরসিংহ গ্রামে নিজ ব্যয়ে একটি অন্নসত্র স্থাপন করেন। ছয় মাস দৈনিক চার-পাঁচশো নরনারী ও শিশু এই অন্নসত্র থেকে অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছিল। ১৮৬৮ সালে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রামগোপাল ঘোষ প্রয়াত হন। ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারির পদ ত্যাগ করেন। এপ্রিল মাসে তার সম্পাদনায় কালিদাসের মেঘদূতম্ প্রকাশিত হয়। ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়র রচিত কমেডি অফ এররস্ অবলম্বনে রচিত বাংলা গ্রন্থ ভ্রান্তিবিলাস। উল্লেখ্য, শোভাবাজার রাজবাড়িতে আনন্দকৃষ্ণ বসুর কাছে তিনি শেকসপিয়রের পাঠ নেন। কথিত আছে, মাত্র পনেরো দিনে তিনি কমেডি অফ এবর-এর এই ভাবানুবাদটি রচনা করেছিলেন। এবছরই বীরসিংহ গ্রামে তার পৈতৃক বাসভবনটি ভস্মীভূত হয়। চিরতরে জন্মগ্রাম বীরসিংহ ত্যাগ করেন ‘বীরসিংহের সিংহশিশু’।

১৮৭০ সালের জানুয়ারি মাসে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় এক হাজার টাকা দান করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। ২০ ফেব্রুয়ারি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য, দুর্গাচরণ ছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা। ১১ আগস্ট বাইশ বছর বয়সী পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণনগর নিবাসী শম্ভুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্দশবর্ষীয়া বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৮৭১ সালের ১২ এপ্রিল কাশীতে মা ভগবতী দেবী প্রয়াত হন।

১৮৭১-৭২ সাল নাগাদ তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। জলহাওয়া পরিবর্তনের জন্য এই সময় তিনি কার্মাটারে (বর্তমানে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অবস্থিত) একটি বাগানবাড়ি কেনেন। সেখানে একটি স্কুলও স্থাপন করেন। ১৮৭২ সালের ১৫ জুন হিন্দু বিধবাদের সাহায্যার্থে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড নামে একটি জনহিতকর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। স্বল্প আয়ের সাধারণ বাঙালির মৃত্যুর পর তার স্ত্রী-পুত্র পরিবারবর্গ যাতে চরম অর্থকষ্টে না পড়েন, তার উদ্দেশ্যেই এই প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা। বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন এর অন্যতম ট্রাস্টি। ১৮৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে স্থাপিত হয় মেট্রোপলিটান কলেজ। সেযুগের এই বেসরকারি কলেজটিই বর্তমানে কলকাতার বিখ্যাত বিদ্যাসাগর কলেজ নামে অভিহিত। এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (দ্বিতীয় পুস্তক)। এই সময়েই মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউটের শ্যামপুকুর শাখাটির প্রতিষ্ঠা। মে মাসে বিধবা বিবাহ বিরোধী পণ্ডিতদের প্রতিবাদের উত্তরে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামের আড়ালে রচনা করেন অতি অল্প হইল এবং আবার অতি অল্প হইল নামে দু-খানি পুস্তক। ১৬ আগস্ট মাইকেল মধুসূদনের নাটক শর্মিষ্ঠা অভিনয়ের মাধ্যমে উদ্বোধিত হল বেঙ্গল থিয়েটার। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই থিয়েটারের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৮৭৪ সালে মাত্র এক বছরেই ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় মেট্রোপলিটান কলেজ গুণানুসারে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল।

শেষ জীবন

[সম্পাদনা]

১৮৭৫ সালের ৩১ মে নিজের উইল প্রস্তুত করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। পরের বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ডের ট্রাস্টি পদ থেকে ইস্তফা দেন। এপ্রিল মাসে কাশীতে পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। এই সময় কলকাতার বাদুড়বাগানে বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। বর্তমানে এই বাড়ি সংলগ্ন রাস্তাটি বিদ্যাসাগর স্ট্রিট ও সমগ্র বিধানসভা কেন্দ্রটি বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত। ১-২ আগস্ট আদালতে উপস্থিত থেকে চকদিঘির জমিদার সারদাপ্রসাদ রায়ের উইল মামলায় উইল প্রকৃত নয় বলে জমিদার পত্নী রাজেশ্বরী দেবীর স্বপক্ষে সাক্ষী দেন। ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি থেকে বাদুড়বাগানে বাস করতে থাকেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। এ বছর বাংলার গভর্নর কর্তৃক সন্মাননা লিপি প্রদান করা হয় তাকে। এপ্রিল মাসে গোপাললাল ঠাকুরের বাড়িতে উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেদের পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ছাত্রদের বেতন হয় মাসিক ৫০ টাকা। ১৮৭৯ সালে মেট্রোপলিটান কলেজ [কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়] কর্তৃক দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত হয়।

১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি বিদ্যাসাগর মহাশয় সিআইই উপাধি পান। ১৮৮১ সালে মেট্রোপলিটান কলেজ থেকে প্রথম বিএ পরীক্ষার্থী পাঠানো হয়। ১৮৮২ সালের ৫ আগস্ট রামকৃষ্ণ পরমহংস তার বাদুড়বাগানের বাড়িতে আসেন। দুজনের মধ্যে ঐতিহাসিক এক আলাপ ঘটে। এই বছর মেট্রোপলিটান কলেজে চালু হয় আইন পাঠ্যক্রম। ১৮৮৩ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন। মার্চে বাণভট্টের হর্ষচরিতম্ তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ১৮৮৪ সালের নভেম্বরে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে ব্রজবিলাস গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়াও প্রকাশিত হয় ‘কস্যচিৎ তত্ত্বান্বেষিণঃ’ ছদ্মনামে বিধবা বিবাহ ও যশোহর হিন্দুধর্মরক্ষিণীসভা পুস্তক। দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি এর নামকরণ করেন বিনয় পত্রিকা। এই নভেম্বরেই কানপুরে বেড়াতে যান এবং সেখানে দিনকতক থাকেন।

১৮৮৫ সালে মেট্রোপলিটান কলেজের বউবাজার শাখা স্থাপিত হয়। ১৮৮৬ সালের অগস্টে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোসহচরস্য’ ছদ্মনামে রত্নপরীক্ষা পুস্তক প্রকাশ করেন। ১৮৮৭ সালের জানুয়ারিতে শঙ্কর ঘোষ লেনের নতুন ভবনে মেট্রোপলিটান কলেজ স্থানান্তরিত হয়। ১৮৮৮ সালের এপ্রিলে নিষ্কৃতিলাভ প্রয়াস, জুনে আখ্যান মঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ), জুলাইতে পদ্যসংগ্রহ নামক সংকলন গ্রন্থের প্রথম ভাগ প্রকাশ করেন। ১৩ আগস্ট পত্নী দীনময়ী দেবীর মৃত্যু হয়। ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে প্রকাশ করেন সংস্কৃত রচনা। ১৮৯০ সালের ১৪ এপ্রিল বীরসিংহ গ্রামে মায়ের নামে স্থাপন করেন ভগবতী বিদ্যালয়। মে মাসে নির্বাচিত উদ্ভট শ্লোকসংগ্রহ শ্লোকমঞ্জরী প্রকাশিত হয়।

বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রয়াত হন ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই, বাংলা ১২৯৮ সনের ১৩ শ্রাবণ, রাত্রি দুটো আঠারো মিনিটে তার কলকাতার বাদুড়বাগানস্থ বাসভবনে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর ১০ মাস ৪ দিন। মৃত্যুর কারণ, ডাক্তারের মতে, লিভারের ক্যানসার।

মৃত্যুর পর ১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বরে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বিদ্যাসাগর চরিত প্রকাশ করেন পুত্র নারায়ণচন্দ্র বিদ্যারত্ন। ১৮৯২ সালের এপ্রিলে ৪০৮টি শ্লোকবিশিষ্ট ভূগোল খগোল বর্ণনম্ গ্রন্থটিও প্রকাশিত হয়। পশ্চিম ভারতের এক সিভিলিয়ন জন লিয়রের প্রস্তাবে বিদ্যাসাগর পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত ও ইউরোপীয় মত অনুসারে এই ভূগোল গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। বিবিসি জরিপকৃত(২০০৪) সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তার স্থান অষ্টম।

নারীশিক্ষা

[সম্পাদনা]

বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বিস্তারের পথিকৃৎ। তিনি উপলব্ধি করেন যে, নারীজাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারতের প্রথম ভারতীয় বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যসাগসর ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। এটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় স্ত্রীশিক্ষা বিধায়নী সম্মেলনী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মে মাসের মধ্যে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১৩০০ ছাত্রী এই স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করত। পরবর্তীকালে তিনি সরকারের কাছে ধারাবাহিক তদবির করে সরকার এই স্কুলগুলোর কিছু আর্থিক ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮ টি। এরপর কলকাতায় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত) এবং নিজের মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

বিধবা বিবাহ আইন

[সম্পাদনা]

সংস্কৃত শাস্ত্রের বিরাট পণ্ডিত হয়েও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণে দ্বিধা করেননি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন তিনি। হিন্দু বিধবাদের অসহনীয় দুঃখ, তাদের প্রতি পরিবারবর্গের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল তাকে। এই বিধবাদের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সর্বস্ব পণ করে সংগ্রাম করেছেন। হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছেন, যে লোকাচার ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত, আসলে তা ধর্মবহির্ভূত স্থবিরতার আচারমাত্র। তার আন্দোলন সফল হয়েছিল। ১৮৫৬ সালে সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন।[১৫][১৬] তবে শুধু আইন প্রণয়নেই ক্ষান্ত থাকেননি বিদ্যাসাগর মহাশয়। তার উদ্যোগে একাধিক বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। তার পুত্রও( নারায়ণচন্দ্র) এক ভাগ্যহীনা বিধবাকে বিবাহ করেন। এজন্য সেযুগের রক্ষণশীল সমাজ ও সমাজপতিদের কঠোর বিদ্রুপ ও অপমানও সহ্য করতে হয় তাকে। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বহুবিবাহের মতো একটি কুপ্রথাকে নির্মূল করতেও আজীবন সংগ্রাম করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। প্রচার করেন বাল্যবিবাহ রোধের সপক্ষেও। এর সঙ্গে সঙ্গে নারীশিক্ষার প্রচারেও যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। শুধু কলকাতায় নয়, নারীমুক্তির বার্তা বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে, বিভিন্ন জেলাতেও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে নারীশিক্ষার সপক্ষে জোর প্রচার চালান তিনি। যদিও তার এই উদ্যোগও সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা নিন্দিত হয়। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পর্যন্ত অত্যন্ত হীন বাক্যবাণে নারীমুক্তি আন্দোলনের ব্যঙ্গ করেন। তবু তার জীবদ্দশাতেই নারীশিক্ষা আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।[১৭][১৮]

শিক্ষা সংস্কার

[সম্পাদনা]

মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় এক হাজার টাকা দান করেন বিদ্যাসাগর। ১৮৭১-৭২ সাল নাগাদ তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। ১৮৭২ সালের ১৫ জুন হিন্দু বিধবাদের সাহায্যার্থে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড নামে একটি জনহিতকর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৮৭৪ সালে মাত্র এক বছরেই ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় মেট্রোপলিটান কলেজ গণনানুসারে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। ১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি বিদ্যাসাগর মহাশয় সিআইই উপাধি পান। ১৮৮৭ সালে মেট্রোপলিটান কলেজ স্থানান্তরিত হয়। বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রয়াত হন ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই (১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১৩ শ্রাবণ)।

বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিক্ষামূলক গ্রন্থ : 'বর্ণপরিচয়' (১ম ও ২য় ভাগ, ১৮৫৫), 'ঋজুপাঠ' (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ, ১৮৫১-৫২), 'সংস্কৃৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা' (১৮৫১), 'ব্যাকরণ কৌমুদী' (১৮৫৩); অনুবাদ গ্রন্থ : হিন্দি থেকে বাংলা 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' (১৮৪৭), সংস্কৃৃত থেকে বাংলা 'শকুন্তলা' (১৮৫৪), 'সীতার বনবাস' (১৮৬০), 'মহাভারতের উপক্রমণিকা' (১৮৬০), 'বামনাখ্যানম্' (১৮৭৩); ইংরেজি থেকে বাংলা 'বাঙ্গালার ইতিহাস' (১৮৪৮), 'জীবনচরিত' (১৮৪৯), 'নীতিবোধ' (১৮৫১), 'বোধোদয়' (১৮৫১), 'কথামালা' (১৮৫৬), 'চরিতাবলী' (১৮৫৭), 'ভ্রান্তিবিলাস' (১৮৬১); ইংরেজি গ্রন্থ : 'পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্', 'সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ', 'সিলেকশনস্ ফ্রম ইংলিশ লিটারেচার'; মৌলিক গ্রন্থ : 'সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব' (১৮৫৩), 'বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' (১৮৫৫), 'বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' (১৮৭১), 'অতি অল্প হইল' (১৮৭৩), 'আবার অতি অল্প হইল' (১৮৭৩), 'ব্রজবিলাস' (১৮৮৪), 'রত্নপরীক্ষা' (১৮৮৬) প্রভৃতি।

চরিত্র

[সম্পাদনা]

বিদ্যাসাগর ছিলেন তার আদর্শ রূপায়নের ক্ষেত্রে নির্মম, কঠোর ও আপোসহীন। বিবেকানন্দ ১৮৮৬ সালে বিদ্যাসাগর পরিচালিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের বৌবাজার শাখার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান। কিন্তু কর্তব্যকর্মে অবহেলার কারণে একমাসের মধ্যেই সেখান থেকে বরখাস্ত হন। সে সময়ের বিখ্যাত বাগ্মী তথা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রগুরু বলে পরিচিত সুরেন্দ্রনাথকে তার অসুবিধার সময়ে চাকরি দিয়েছিলেন, কিন্তু সুরেন্দ্রনাথের নিষ্ঠার অভাব দেখে তাঁকে চাকরি থেকে সরিয়েও দিয়েছিলেন। নিজের জামাই সূর্যকুমারকে স্কুলের দায়িত্ব থেকে এক কথায় অপসারিত করেন, বিদ্যালয় তহবিলে সামান্য গরমিল লক্ষ্য করে। পুত্র নারায়ন বিধবাবিবাহ করতে সম্মত হওয়াতে বিদ্যাসাগর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করেও এই বিবাহ সম্পন্ন করেন। আবার যখন জানলেন পুত্র নারায়ন ‘যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী’ হয়েছেন তখন পুত্রের সাথে সমস্ত ‘সংস্রব ও সম্পর্ক’ পরিত্যাগ করেন। এই ধরনের মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর। [১৯]

দয়ার সাগর নামে।

মাতৃভক্তি ছিল তার চরিত্রে অন্যতম গুণ। মনে করা হয়, বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলন ও মুক্তচেতনার নেপথ্যে জননী ভগবতী দেবীর বিশেষ প্রেরণা ছিল। বীরসিংহ গ্রামে তিনি মায়ের নির্দেশে বিদ্যালয়, অবৈতনিক ছাত্রাবাস ইত্যাদি গড়েছিলেন। তার বিধবা বিবাহ প্রবর্তনেও এই গ্রাম্য মহিলার বিশেষ অবদান ছিল। তিনিই পুত্রকে আদেশ করেছিলেন, বিধবাদের দুঃখনিবৃত্তির বন্দোবস্ত করতে। সম্ভবত, এই মায়ের ডাকে একবার তিনি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দামোদর নদ সাঁতরেও পার হয়েছিলেন।

বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা

[সম্পাদনা]

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার মনে করা হয়। যদিও তত্ত্বগত ভাবে বাংলা গদ্যের জনক তিনি নন। কারণ বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তার আগমনের বহুপূর্বেই গদ্যরচনার সূত্রপাত ঘটেছিল। কিন্তু সেইসব গদ্য ছিল শিল্পগুণবিবর্জিত নীরস এবং অনেক ক্ষেত্রেই অসংলগ্ন বাক্যসমষ্টি। বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা সাধু গদ্যের একটি মান্য ধ্রুবক নির্দেশনা করেন। প্রয়োজনবোধে সেই গদ্যে চলিত ভাষার গতিশীলতাও যুক্ত করেন। কল্পনা ও স্বকীয় পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণে যে গদ্যভাষার জন্ম তিনি দেন, তা ছিল সরস, সুমধুর, সুশ্রাব্য, ছন্দোময় ও গতিশীল। এই অর্থে তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের নব জন্মদাতা। তিনি বাংলা আধুনিক গদ‍্যের জনক।

মান্য সাধু বাংলা গদ্যের শিল্পরূপটি ঠিক কিরকম হতে পারে, তার প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল, সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনূদিত বিদ্যাসাগরের বাংলা রচনাগুলিতে। ১৮৫৪ সালে শকুন্তলা ও ১৮৬০ সালে সীতার বনবাস গ্রন্থে তার সেই বিশিষ্ট গদ্যশৈলীর পরিচয় পাওয়া যাবে :

শকুন্তলার অধরে নবপল্লবশোভার সম্পূর্ণ আবির্ভাব ; বাহুযুগল কোমল বিটপের বিচিত্র শোভায় বিভূষিত ; আর, নব যৌবন, বিকশিত কুসুমরাশির ন্যায়, সর্বাঙ্গ ব্যাপীয়া রহিয়াছে। (শকুন্তলা, প্রথম পরিচ্ছেদ)
লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্য্য! এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমান জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলংকৃত ; অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয় ; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবলবেগে গমন করিতেছে। (সীতার বনবাস, প্রথম পরিচ্ছেদ, আলেখ্যদর্শন)

এই চিত্ররূপময়, কাব্যিক ও অলংকার বহুল গদ্যভাষার পাশাপাশি প্রয়োজন বোধে বিদ্যাসাগরকে লৌকিক ভাষার আদর্শে দ্রুতগামী ও শ্লেষাত্মক গদ্যরচনা করতেও দেখা যায়। জীবনের শেষ পর্বে রচিত ব্রজবিলাস তার একটি উদাহরণ:

এই কয় প্রশ্নের উত্তর পাইলেই, বিদ্যারত্ন ও কপিরত্ন, উভয় খুড় মহাশয়ের সঙ্গে, নানা রঙ্গে, হুড়হুড়ি ও গুঁতোগুঁতি আরম্ভ করিব। প্রশ্নের উত্তর পাইলে, হাঙ্গাম ও ফেসাৎ উপস্থিত করিবেক, এমন স্থলে উত্তর না দেওয়াই ভাল, এই ভাবিয়া, চালাকি করিয়া, লেজ গুটাইয়া, বসিয়া থাকিলে আমি ছাড়িব না। (ব্রজবিলাস)

এই ভাষা আলালি ভাষার মতো ফারসি শব্দবহুল নয়, আবার হুতোমি ভাষার অশ্লীলতা দোষ থেকেও মুক্ত। বরং স্বামী বিবেকানন্দ যে বীর্যবান অথচ সরস বাংলা চলিত গদ্যের সূত্রপাত করেছিলেন, তারই পূর্বসূরী।

সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে বিদ্যাসাগরের অসামান্য দখল ছিল। আবার নিজ চেষ্টায় ইংরেজি শিখে সেই ভাষার সাহিত্যের সঙ্গেও সম্যক পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃত শব্দ ও পদবিন্যাসের শ্রুতিমাধুর্য ও গাম্ভীর্যকেই তিনি স্থান দিয়েছিলেন বাংলা গদ্যে; দুর্বোধ্যতা বা দুরুহতাকে নয়। অন্যদিকে কাব্যিক ছন্দোময়তায় গদ্যকে দিয়েছিলেন এক ললিত সুডৌল রূপ। গ্রহণ-বর্জনের যে অসামান্য ক্ষমতা তার মধ্যে ছিল, তার মাধ্যমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক গদ্যের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহারিক গদ্য ও সমকালীন সংবাদপত্রগুলির নিকৃষ্ট গদ্যনমুনা সব থেকেই ছেঁকে নিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় সাহিত্যগুণ। আবার ইংরেজি সাহিত্যের আদর্শে যতিচিহ্নের ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যে কালান্তর সূচনা করতেও পিছপা হননি তিনি। নিছক ব্যবহারিক বাংলা গদ্যকে তিনি উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক গদ্যে বিবর্তিত করতে তার প্রয়াস ব্যর্থ হয়নি। তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, “বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কর্মকুশলতা দান করিয়াছিলেন।”

উত্তরাধিকার

[সম্পাদনা]

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্যাসাগরকে নিয়ে চতুর্দশপদী কবিতা রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার চারিত্রপূজা গ্রন্থে বিদ্যাসাগরের জীবন ও কর্ম নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন।

বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিদ্যাসাগরের সম্মানে একাধিক উদ্যোগ গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালে মেদিনীপুর শহরে স্থাপিত হয় তার নামাঙ্কিত বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯২ সালে বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ শতবর্ষ উপলক্ষ্যে কলকাতা ও হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেতু দ্বিতীয় হুগলি সেতু "বিদ্যাসাগর সেতু" নামে উৎসর্গিত হয়।

বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থাবলি

[সম্পাদনা]

শিক্ষামূলক গ্রন্থ

[সম্পাদনা]

অনুবাদ গ্রন্থ

[সম্পাদনা]

  • হিন্দি থেকে বাংলা
  • বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭ ; লল্লুলাল কৃত বেতাল পচ্চীসী অবলম্বনে)
  • সংস্কৃত থেকে বাংলা
  • শকুন্তলা (ডিসেম্বর, ১৮৫৪ ; কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে)
  • সীতার বনবাস (১৮৬০) - ভবভূতিরউত্তররামচরিতম্‌ নাটকের আখ্যানবস্তু।[২০]
  • মহাভারতের উপক্রমণিকা (১৮৬০ ; ব্যাসদেব মূল মহাভারত-এর উপক্রমণিকা অংশ অবলম্বনে)
  • বামনাখ্যানম্ (১৮৭৩ ; মধুসূদন তর্কপঞ্চানন রচিত ১১৭টি শ্লোকের অনুবাদ)
  • ইংরেজি থেকে বাংলা
  • বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮ ; মার্শম্যান কৃত হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচিত)
  • জীবনচরিত (১৮৪৯ ; চেম্বার্সের বায়োগ্রাফিজ অবলম্বনে রচিত)
  • নীতিবোধ (প্রথম সাতটি প্রস্তাব – ১৮৫১ ; রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্সের মরাল ক্লাস বুক অবলম্বনে রচিত)
  • বোধোদয় (১৮৫১ ; চেম্বার্সের রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে রচিত)
  • কথামালা (১৮৫৬ ; ঈশপস ফেবলস অবলম্বনে রচিত)
  • চরিতাবলী (১৮৫৭ ; বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা অবলম্বনে রচিত)
  • ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯ ; শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এররস অবলম্বনে রচিত)

ইংরেজি গ্রন্থ

[সম্পাদনা]

  • পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্
  • সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ
  • সিলেকশনস্ ফ্রম ইংলিশ লিটারেচার

মৌলিক গ্রন্থ

[সম্পাদনা]

  • সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩)
  • বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫)
  • বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (প্রথম খন্ড ১৮৭১, ২য় খন্ড ১৮৭৩)
  • অতি অল্প হইল এবং ”আবার অতি অল্প হইল দুখানা পুস্তক (১৮৭৩, বিধবা বিবাহ বিরোধী পণ্ডিতদের প্রতিবাদের উত্তরে 'কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য' ছদ্মনামে।)
  • ব্রজবিলাস, যৎকিঞ্চিৎ অপূর্ব্ব মহাকাব্য (নভেম্বর, ১৮৮৪) - "কবিকুলতিলকস্য কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য" ছদ্মনামে রচিত। বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের রচনার প্রত্যুত্তরে লিখিত হয়।[২১]
  • রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬)
  • প্রভাবতী সম্ভাষণ (সম্ভবত ১৮৬৩)
  • জীবন-চরিত (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)
  • নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস (১৮৮৮)
  • ভূগোল খগোল বর্ণনম্ (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)

সম্পাদিত গ্রন্থ

[সম্পাদনা]

চলচ্চিত্রায়ণ

[সম্পাদনা]

তার লেখা অনুবাদিত গল্প অবলম্বনে তৈরী হয় ভ্রান্তিবিলাস চলচ্চিত্র।

নারী শিক্ষায় অবদান

[সম্পাদনা]

গ্রন্থপঞ্জি

[সম্পাদনা]

  • অঞ্জলি বসু (সম্পাদিত) ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৭৬
  • অমরেন্দ্রকুমার ঘোষ ; যুগপুরুষ বিদ্যাসাগর : তুলিকলম, কলকাতা, ১৯৭৩
  • অমূল্যকৃষ্ণ ঘোষ ; বিদ্যাসাগর : দ্বিতীয় সংস্করণ, এম সি সরকার, কলকাতা, ১৯১৭
  • অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ; বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর : মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৯৭০
  • ইন্দ্রমিত্র ; করুণাসাগর বিদ্যাসাগর : আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৬৬
  • গোপাল হালদার (সম্পাদিত) ; বিদ্যাসাগর রচনা সম্ভার (তিন খণ্ডে) : পশ্চিমবঙ্গ নিরুক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, কলকাতা, ১৯৭৪-৭৬
  • বদরুদ্দীন উমর ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ : দ্বিতীয় সংস্করণ, চিরায়ত, কলকাতা, ১৯৮২
  • বিনয় ঘোষ ; বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ : বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ
  • বিনয় ঘোষ ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : অনুবাদক অনিতা বসু, তথ্য ও বেতার মন্ত্রক, নয়াদিল্লি, ১৯৭৫
  • ব্রজেন্দ্রকুমার দে ; করুণাসিন্ধু বিদ্যাসাগর : মণ্ডল অ্যান্ড সন্স, কলকাতা, ১৯৭০
  • মহম্মদ আবুল হায় আনিসুজ্জামন ; বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ : স্টুডেন্টস ওয়েজ, ঢাকা, ১৯৬৮
  • যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ; বিদ্যাসাগর : পঞ্চম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৪১
  • যোগীন্দ্রনাথ সরকার ; বিদ্যাসাগর : ১৯০৪
  • রজনীকান্ত গুপ্ত ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : ১৮৯৩
  • রমাকান্ত চক্রবর্তী (সম্পাদিত) ; শতবর্ষ স্মরণিকা : বিদ্যাসাগর কলেজ, ১৮৭২-১৯৭২ : বিদ্যাসাগর কলেজ, ১৯৭২
  • রমেশচন্দ্র মজুমদার ; বিদ্যাসাগর : বাংলা গদ্যের সূচনা ও ভারতের নারী প্রগতি : জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ; বিদ্যাসাগর-চরিত : বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা
  • রাধারমণ মিত্র ; কলিকাতায় বিদ্যাসাগর : জিজ্ঞাসা, কলিকাতা, ১৯৪২
  • রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ; চরিত্র কথা : কলকাতা, ১৯১৩
  • শঙ্করীপ্রসাদ বসু ; রসসাগর বিদ্যাসাগর : দ্বিতীয় সংস্করণ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯২
  • শঙ্খ ঘোষ ও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত) ; বিদ্যাসাগর : ওরিয়েন্ট, কলকাতা
  • শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ; বিদ্যাসাগর চরিত : কলকাতা, ১২৯৪ বঙ্গাব্দ
  • শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ; বিদ্যাসাগর জীবনচরিত : কলকাতা
  • শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ; বিদ্যাসাগর চরিত ও ভ্রমণিরাস : চিরায়ত, কলকাতা, ১৯৯২
  • শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : জীবনীকোষ, ভারতীয় ঐতিহাসিক, কলকাতা, ১৯৩৬
  • শামসুজ্জামান মান ও সেলিম হোসেন ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : চরিতাভিধান : বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫
  • সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস (সম্পাদিত) ; বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী (তিন খণ্ডে) : বিদ্যাসাগর স্মৃতি সংরক্ষণ সমিতি, কলকাতা, ১৩৪৪-৪৬ বঙ্গাব্দ
  • সন্তোষকুমার অধিকারী ; বিদ্যাসাগর জীবনপঞ্জি : সাহিত্যিকা, কলকাতা, ১৯৯২
  • সন্তোষকুমার অধিকারী ; আধুনিক মানসিকতা ও বিদ্যাসাগর : বিদ্যাসাগর রিসার্চ সেন্টার, কলকাতা, ১৯৮৪
  • হরিসাধন গোস্বামী ; মার্কসীয় দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগর : ভারতী বুক স্টল, কলকাতা, ১৯৮৮
  • সুবোধ চক্রবর্তী; বিদ্যাসাগর রচনাবলী, অখণ্ড সংস্করণ (সম্পাদনা) কামিনী প্রকাশালয়,কলকাতা ১৪২৩ বঙ্গাব্দ।

[২২]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]

  1. ড. হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, বঙ্গসাহিত্যাভিধান, ১ম খণ্ড, ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৮৭ সংস্করণ, পৃ. ১৫৫-১৫৬
  2. "বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি: ৮- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর"। বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০। 
  3. গোলাম মুরশিদ (২০১২)। "বিদ্যাসাগর, ঈশ্বরচন্দ্র"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743। 
  4. "Ishwar Chandra Vidyasagar"। । ২০১৮-১২-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১২-২০। 
  5. "Ishwar Chandra Vidyasagar: A Profile of the Charitable Protagonist"। । সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১২-২০। 
  6. "বিদ্যাসাগরের অন্তরালে ঈশ্বরচন্দ্র"। । সংগ্রহের তারিখ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০। 
  7. বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাশ, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন , বুকল্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৪৭ সাল, পৃ. ৪
  8. বিদ্যাসাগর (চতুর্থ সংস্করণ), শ্রীবিহারিলাল সরকার প্রণীত , শাস্ত্র-প্রকাশ কার্য্যালয় থেকে শ্রীহরিপদ চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত, কলিকাতা, ১৩২৯ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১৪
  9. মিত্র, ইন্দ্র (প্রথম সংস্করণ ১৯৭১)। বিদ্যাসাগরের ছেলেবেলা। আনন্দ পাবলিশার্স। পৃষ্ঠা ৯৬। আইএসবিএন 978-81-7066-731-5। 
  10. বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ (১৮৯১)। বিদ্যাসাগর চরিত। কলকাতা: দ্য ক্যালকাটা লাইব্রেরি। পৃষ্ঠা ৩। 
  11. বিদ্যাসাগর (চতুর্থ সংস্করণ), শ্রীবিহারিলাল সরকার প্রণীত , শাস্ত্র-প্রকাশ কার্য্যালয় থেকে শ্রীহরিপদ চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত, কলিকাতা, ১৩২৯ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১৫
  12. বিদ্যাসাগর চরিত (স্বরচিত), শ্রীনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্কলিত , The Calcutta Library, কলিকাতা, ১৮৯১ সাল, পৃ. ৩-৭
  13. লাল, মোহন (২০০৬)। "ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর"। দি এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইন্ডিয়ান লিটারেচার। সাহিত্য অকাদেমি। পৃষ্ঠা ৪৫৬৭–৪৫৬৯। আইএসবিএন 9788126012213। 
  14. বিদ্যাসাগর ও অন্যেরা, আনিসুজ্জামান, পত্রভারতী (বইসাঁকো), কলকাতা, ২০২০ (ভারতীয়) সংস্করণ, পৃ. ১১
  15. Amit Kumar Gupta (২০১৫)। Nineteenth-Century Colonialism with the Great Indian Revolt। Taylor & Francis। পৃষ্ঠা 30। আইএসবিএন 978-1-317-38668-1। 
  16. Belkacem Belmekki (২০০৮)। "A Wind of Change: The New Country Colonial Policy in Post-Revolt India"। AEDEAN: Asociación Española de Estudios Anglo-americanos2 (2): 111–124। জেস্টোর 41055330। 
  17. H. R. Ghosal (১৯৫৭)। "The Revolution Behind the Revolt (A comparative study of the causes beat somebody to it the 1857 uprising)"। Proceedings of distinction Indian History Congress20: 293–305। জেস্টোর 44304480। 
  18. Pratima Asthana (১৯৭৪)। Women's Movement in India। Vikas Publishing House। পৃষ্ঠা 22। আইএসবিএন 978-0-7069-0333-1। 
  19. ↑[১]ওয়েব্যাক মেশিনেআর্কাইভকৃত ১৬ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে, বাংলাদর্পণ
  20. ↑"বাংলা সাহিত্যের গ্রন্থপঞ্জি: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনাবলি বিষয়ক একটি বিবরণ", হেরমান ব্রকহাউস, অনুবাদ: জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, সম্পাদনা: দ্বিজেন্দ্র ভৌমিক, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০২০ সংস্করণ, পৃ. ৩৫০
  21. ↑"বিদ্যাসাগর ও অন্যেরা", আনিসুজ্জামান, পত্রভারতী (বইসাঁকো), কলকাতা, ২০২০ সংস্করণ, পৃ. ৩৩
  22. ↑(তথ্যসূত্র বিন্যাসে কৃতজ্ঞতা স্বীকার : পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকার বিদ্যাসাগর সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৯৪)

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]